মরবো তবুও পালাব না, বলছে গাজাবাসী
- আপডেট সময় : ০২:৪০:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ১৭৬ বার পড়া হয়েছে
পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিমুখী নীতি প্রবল হয়ে উঠছে ফিলিস্তিন ইসরায়েল ইস্যুতে। ইউক্রেনে রাশিয়ায় হামলায় পশ্চিমারা যেমন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। ফিলিস্তিন ইস্যুতে সেই চিত্র উল্টে গেছে। ইসরায়েল গাজায় হাজার হাজার শিশুদের হত্যার পরও এ বিষয়ে অনেকটাই নিরব পশ্চিমারা। তবে বিশ্ব যে অবস্থান নিক না কেন গাজাবাসী মরে গেলেও তাদের জায়গা থেকে পালাতে রাজি নয়।
আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ১৯৪৮ সালে সাত লাখ ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। যেসব এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিরা চলে গিয়েছিল, সেসব এলাকার দখল নিয়েছিল ইসরায়েল। গাজায় বর্তমান ২১ লাখের বেশি বাসিন্দার মধ্যে বাস্তুচ্যুত ওই ফিলিস্তিনিদের উত্তরসূরীর সংখ্যাই ১৭ লাখ।
১৯৪৮ সালে আবু সাদার পরিবারকে বর্তমান দক্ষিণ ইসরায়েল থেকে জোরপূর্বক বের করে দেওয়া হয়। শুধু যে আবু সাদার পরিবারকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তা নয়, তার মতো আরো বহু পরিবারকে নিজেদের বসতি ছাড়তে বাধ্য করেছিল দখলদার ইসরায়েল। এরপর তারা গাজার ঠিক উত্তরে জাবালিয়া শহরে নতুন করে বসতি স্থাপন করে।
এ ঘটনার ৭৫ বছর পর এবার ইসরায়েলি বাহিনীর নজর এখন এই শহরটিতেও। আবু সাদার উত্তরসূরীসহ এখানকার সব বাসিন্দাকে এলাকা ছাড়তে বলেছে ইসরায়েল। গাজার চারপাশজুড়ে বৃষ্টির মতো বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলায় এ শহরের একটি পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হয়েছেন। এরপরেও পরিবারটি নিজেদের ভিটা ছাড়তে নারাজ।
শহরের বাসিন্দা বাসিল আবু সাদা (৩৫) বলেন, ‘আমি কাউকে আর পরোয়া করি না’। তার ভয় হলো যদি তারা নিজেদের ভিটা ছেড়ে চলে যায়, তাহলে তারা খাবার বা কোনো আশ্রয় খুঁজে পাবে না। এমনকি আবার ফিরে আসার সুযোগও নাও হতে পারে। তিনি বলেন, ‘মরলে মরব’।
স্থল অভিযান শুরুর আগে এ অঞ্চলে ব্যাপক বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। তবুও উত্তর গাজার কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি বাসিল আবু সাদার মতোই নিজেদের ভূমি ছাড়তে চান না। অব্যাহত হামলায় পানি ও খাদ্য সংকটের পর ফিলিস্তিনিরা এবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
উত্তর গাজার বাসিন্দা ও পেশায় প্রকৌশলী আয়াদ সোবাকি (৪৫) জানান, তার ১০ সদস্যের পরিবার গাজা ছাড়বে না। ১৯৪৮ সালে তাদের পূর্বসূরীদের বাস্তুচ্যুতিও ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছিল। তিনি বলেন, ওই সময়েও ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের কথায় ঘরবাড়ি ছেড়েছিল। তারা আশা করেছিল এক বা দুই সপ্তাহ পর তারা নিজেদের বাড়ি ফিরতে পারবে। কিন্তু তারা সেটি কখনোই পারেনি।
সোবাকি বলেন, ‘আমি কীভাবে আমার দেশের জন্য কিছু করতে পারি? আমি আমার ঘরেই থাকব। দেশের জন্য এছাড়া আমার করার আর কিছুই নেই।
তিনি বলেন, তার পরিবারের সদস্যরা রাতে যখন ঘুমান, তখন কোনো দুর্ঘটনার আশঙ্কায় তিনি প্রতিদিন ভোর পর্যন্ত জেগে থাকেন। দিনের বেলা তিনি সৌরবিদ্যুৎ চালিত টেলিভিশনে বাড়ির আশেপাশের এলাকায় ইসরায়েলি হামলার খোঁজখবর নেন।
ইসরায়েলের উত্তর গাজা থেকে অধিবাসীদের দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশের মধ্যে অনেকে অতীতে ফিলিস্তিনিদের গণহারে উচ্ছেদ করে ভূমি দখলের মিল দেখতে পাচ্ছেন। উত্তর গাজায় ফিলিস্তিনিরা সরে গেলে ইসরায়েল তা দখলে নেবে- এমন কথাও বলছেন অনেকে।
গাজার মানবাধিকার বিষয়ক গবেষক হুসেইন হামাদ জানান, তিনি ও তার পরিবারের ২০ সদস্য জাবালিয়ার তেল জাতার এলাকায় বসবাস করছেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি হামলা থেকে বাঁচতে তার পূর্বসূরীরা বারবারা গ্রাম থেকে পালিয়ে আসে। গ্রামটি গাজা ও ইসরায়েলের আশকেলন শহরের সীমান্তে অবস্থিত। এতে তারা নিজেদের ঘরবাড়িসহ ১০ একর কৃষিজমি হারান।
হুসেইন হামাদ বলেন, আমরা এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করব না। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বাড়িতেই থাকব। তিনি আরও বলেন, জাবালিয়ায় বসবাসের অবস্থা পুরোপুরি বিপর্যস্ত। বিদ্যুৎ নেই, প্রয়োজনীয় পানিটুকুও মিলছে না। রুটি ও পানির জন্য তার পরিবারকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে।
২৩ বছর বয়সী আব্দুল্লাহ হাসানিন নামে এক অধিবাসী বলেন, গাজার যথেষ্ট সংখ্যক অধিবাসীকে মিশরের সিনাই অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য করতে পারলেই ফিলিস্তিনি ইস্যুর পরিসমাপ্তি হবে। তিনি বলেন, ‘আমি মরব, তবুও সিনাই কিংবা অন্য কোথাও শরণার্থী হবো না।’
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ইতিহাসবিদ রাশিদ খালিদি বলেন, দ্বিতীয়বারের মতো বাস্তুচ্যুতির ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের হয়তো গাজার বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে না, এটি হতে পারে তাদের গাজার এক অংশ থেকে আরেকটি অংশে স্থানান্তর।
সর্বশেষ গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আকষ্মিক হামলায় ১৪০০ জন নিহত হয়। হামলা চলাকালে অনেককে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যায় হামাস। জবাবে ইসরায়েলও হামলা শুরু করে। হামাসের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বিমান হামলার পর এবার তারা স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেজন্য বেসামরিক নাগরিকদের উত্তর গাজা থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলের বিমান হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে সাতশ’র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের বেশিরভাগ নারী ও শিশু। একদিনে এত মৃত্যু এর আগে গাজাবাসী কখনো দেখেনি।
গাজায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় ৬ হাজার ৫৪৬ জন নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই তথ্য নিশ্চিত করে জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ২ হাজার ৭০৪ জন শিশু এবং ১ হাজার ৭০৪ জন নারী। এছাড়া গাজায় আহতের সংখ্যা ১৭ হাজারের বেশি।
এছাড়া ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা একশ ছাড়িয়েছে। source : dhakamail